Dolon Champa Dutta

আচ্ছা এই মুহূর্তে যদি আপনার কোন ইচ্ছে কেউ পূরণ করতে চায়, আপনি কি ইচ্ছের কথা জানাবেন?

আমি আমার মাবাবার জন্য খুব সুন্দর, ভালো, পরিপাটি, উপযুক্ত একটা বৃদ্ধাশ্রম চাইবো। যেই বৃদ্ধাশ্রমের এদেশে বড়ই অভাব।

প্রথমটুকু পড়েই নিশ্চয় আমাকে কুলাঙ্গার বলে ফেলেছেন? আমার মা বাবার পোড়া কপালের জন্য আফসোস করছেন? কি মেয়ের জন্ম দিয়েছেন আমার মাবাবা, যে তাদের আমি বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে চাচ্ছি!

বেশ। এবার বাকিটুকু পড়ুন।

আমি আমাকে দিয়েই বলি। মফস্বলের একটা একক ছোট্ট পরিবারে আমার বড় হওয়া। মা, বাবা আর আমি মিলে পরিবার৷ মায়ের সরকারি চাকরি, বাবার ব্যবসা৷ মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবার। সবাই নিজের মতো ব্যস্ত। একটু একটু করে বড় হলাম। পড়ালেখায় প্রবল ইচ্ছে৷ মফস্বল ছেড়ে শহরে এলাম। মা বাবার বয়স হলো। মা চাকরি থেকে অবসর নিলেন। বাবা নিজের ব্যবসা হওয়াতে অবসর নিতে পারেননি। তাই সারাদিন দোকানে তার আগের মতোই সময় কাটতে লাগলো।

সারাজীবন ৯-৫ টা চাকরি করা ব্যস্ত মা এখন বাড়িতে একা। না আছে কথা বলার সঙ্গী, না আছে অসুস্থ হলে কাছে বসে থাকার কেউ।

দিন এগোতে থাকলো। আমি যতো বড় হই, মা বাবার ততো বয়স হয়। ভালো রেজাল্ট করে ক্যারিয়ারে মন দেবার সময় এখন আমার৷ বাইরে পড়তে যাওয়া, পিএইচডি আকাশ কুসুম পরিকল্পনা।

কিন্তু, মনের ভেতর ভয়। মাবাবার তো কেউ নেই আর! আমি বাইরে পড়তে গেলে তাদের কে দেখবে?

কি? মিলে যাচ্ছে? পুরোটা না হলেও কিছুটা? বিশেষ করে বাবামায়ের একা সন্তান যারা, জীবনে এই অধ্যায়টা তাদের ফেস করতেই হয়। কারো দেশ ছেড়ে বাইরে, কারো গ্রাম ছেড়ে শহরে, কারো বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া পড়েই। ঘরে পড়ে থাকেন তখন বাবা মা দুটো মানুষ। অসুস্থ হলেও সবসময় দেখতে আসার সুযোগ পাননা তাদের৷ প্রতিদিন হয়তো কাজের চাপে খোঁজ নেওয়াও হয়না। কিংবা হয়তো দিনশেষে একবার কথা হয়, তাও মুঠোফোনে৷ সপ্তাহান্তে একদিন বা মাসান্তে দুদিন যেয়ে হয়তো সামনাসামনি দেখে আসেন তাদের।

আপনিও জানেন, তারা ভালো নেই। তাদের এই বৃদ্ধ বয়সে একা একা লাগে, বন্ধুহীন লাগে৷ কিন্তু কাজ বাদ দিয়ে তাদের সাথে থাকাটাও সম্ভব না৷

অথবা ধরে নিলাম, মাবার সাথেই থাকেন আপনি৷ সকাল হলে কাজে যান, রাতে ফেরেন। সারাটাদিন বাড়িতে সেই দুটো মানুষ। আর কোনকারনে এইদুজনের একজন যদি নেই হয়ে যান তবে পড়ে রইলেন সঙ্গীহীন একা মা বা বাবা৷

এবার ভাবুন তো, কট্টুকু সময় দেন মা, বাবা, ঠাকুমা, দাদু বা পরিবারের বয়স্ক অন্য মানুষগুলোকে? কট্টুকু সময় দেবার সুযোগ পান? ভাবুন, কেমন লাগে এই মানুষগুলোর? গল্পবিহীন বন্ধুহীন, মানুষহীন সময় কাটে তাদের। ঢাকায় থাকলে মা যখন ফোনে বলেন, ‘একটা কথা বলার মানুষ নেই। সারাদিন একা একা লাগে। তুই কবে আসবি?’ তখন না বুকটা মোচড় দেয়।

কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি কিসে খুব ভয় পাই। উত্তর দেবো, আমি বন্ধুহীন ভাবে বুড়ো হতে ভয় পাই। একা থাকতে ভয় পাই। আর এই ভয়টা আমি মাবাবাকে নিয়েও পাই। এজন্যই তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম চাই আমি।

এমন একটা বৃদ্ধাশ্রম যেখানে মা বাবার বন্ধু থাকবে অনেক। যেখানে অসুস্থ হলে সেবার ব্যবস্থা থাকবে। ভালো খাবার থাকবে৷ যেখানে মন খারাপের সুযোগ থাকবেনা। বাগানে ফুল ফুটবে, গাছে পাখি ডাকবে৷ পিয়ানোতে গান বাজবে। ইচ্ছেমতো গল্প করতে পারবেন, ঘুরতে পারবেন, যেদিক খুশি বন্ধু সাথে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারবেন। এমন বৃদ্ধাশ্রম। যেখানে মাবাবাকে রেখে আমি বাইরে পড়তে যেতে পারবো। সুযোগ হলেই মাবাবাকে দেখতে যেতে পারবো।

বৃদ্ধাশ্রম মানেই নচিকেতার গান নয়। বৃদ্ধাশ্রম মানেই ছেলেমেয়ে দেখেনা, তাই ফেলে দিয়ে গেছে নয়। বৃদ্ধাশ্রম মানেই মাথাগোজার ঠাঁই নয়। বৃদ্ধাশ্রম মানেই সুযোগ থাকতেও বাবামায়ের থেকে দূরে থাকা নয়।

‘Old people with other old people are not so old.’ আমি আমার মা বাবাকে সুস্থ দেখতে চাই, আনন্দে দেখতে চাই। আমি আমার বৃদ্ধ বয়সটাও আনন্দে কাটাতে চাই। তাই ‘ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’ শুনলেই আমার চোখে জল আসেনা৷ বৃদ্ধাশ্রম শব্দটাকে অভিশাপ না ভেবে একটু অন্য ভাবেও ভেবে দেখবেন।

নিজের বৃদ্ধ বয়সটা একা না কাটুক কারো।

লেখা: দোলন চাঁপা

Share:

Facebook
Twitter

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

On Key

Related Posts

Nafiza Rahman Mou

“আমার বয়স তখন ১৩, প্রেমে পড়েছি! বাল্যপ্রেম যেটাকে বলে, ৬ মাস না গড়াতেই প্রিয় মানুষটির হাত ধরে ঘর ছাড়ি। যা হবার তাই হলো! দুই পরিবারের

অসময়ের ডাক

About The Campaign Handwritten letter festival “Oshomoyer Daak” was organized by KrayonMag, a social story telling platform. This one-of-a-kind event, which is very pertinent in

Dolon Champa Dutta

আচ্ছা এই মুহূর্তে যদি আপনার কোন ইচ্ছে কেউ পূরণ করতে চায়, আপনি কি ইচ্ছের কথা জানাবেন? আমি আমার মাবাবার জন্য খুব সুন্দর, ভালো, পরিপাটি, উপযুক্ত

Dolon Champa Dutta

সালটা ২০১৫। টিএসসিতে আড্ডা গল্পের আসরে আলাপ হয় কিছু রঙিন মানুষের সাথে। প্রথম প্রথম দেখা হলে হাসির বিনিময় হতো। আস্তে আস্তে কথা বলা, সখ্যতা বাড়ল