সালটা ২০১৫। টিএসসিতে আড্ডা গল্পের আসরে আলাপ হয় কিছু রঙিন মানুষের সাথে। প্রথম প্রথম দেখা হলে হাসির বিনিময় হতো। আস্তে আস্তে কথা বলা, সখ্যতা বাড়ল তাদের মধ্যের দুজনের সাথে। এরপর আমরা একসাথে বাদাম খেতাম কখনো, কখনোবা ফুচকা কিনে খাওয়াতেন তারা৷ একবার বৈশাখে আমায় হাত ভর্তি লাল চুড়ি কিনে দিলেন।
সেই সব সুখী সুখী সময়গুলোর একদিনের কথা। খবর পেলাম একজন প্রসুতি নারীর রক্ত লাগবে। বোধহয় এবি পজেটিভ। সিজার হবে তার৷ পরিবারের লোক রক্ত পাচ্ছেননা কোথাও খুঁজে। আমরা বন্ধুরাও খোঁজ খবর করে চেনাজানাতে রক্ত পাচ্ছিনা৷ ওইদিকে ডাক্তার তাড়া দিচ্ছেন।
এরমধ্যে বন্ধুদের একজন নিয়ে আসল ইমু আপুকে। ইমু আপু, আমাদের সেই নতুন দুই বন্ধুদের একজন। তার রক্তের গ্রুপ আর অই মা হতে যাওয়া রোগীর গ্রুপ একই। আমরা পেশেন্টের হাজবেন্ডের সাথে ইমু আপুর আলাপ করাতেই তিনি আড়ালে ডেকে বললেন ইমু আপুর রক্ত তারা নেবেন না৷ তাদের বাচ্চা এতেকরে অসুস্থ হয়ে জন্ম নেবে৷
ওহ বলা হয়নি। ইমু আপু একজন বৃহন্নলা। একজন হিজরা। সমাজে নারী কিংবা পুরুষ হয়ে জন্মাতে পারেননি বলে তার রক্ত আজ ব্রাত্য। আমরা বোঝাতে লাগলাম। ভদ্রলোক কথা না শুনেই চলে গেলেন। আমরাও বন্ধুরা মিলে ইমু আপুকে নিয়ে চলে এলাম। আপুর মুখটা ভার। টিএসসিতে আপুকে রেখে নিজেদের হোস্টেল, বাসার পথে সবাই রওনা দিলাম।
খানিক বাদে আরেক বন্ধুর ফোন। সেই হাজবেন্ড ভদ্রলোক রক্ত পাননি কোথাও। ডাক্তারের সাথে কথা বলে অগত্যা এক ‘হিজরার’ রক্ত নিতেই রাজি হয়েছেন। আমার বন্ধু সেই ছেলেটা রোগীর হাজবেন্ডকে রেগেমেগে বলেছিল, হিজরা বলে কি মানুষ না? একবার লাথি ঝাটা মেরে তাড়িয়ে দেবেন। আবার কাওকে না পেয়ে ডাকবেন আর চলে আসবে? তাদের কি মান সম্মান নেই! ভদ্রলোক হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলেন।
আমাদের ইমু আপু তার আরেক সখী নদী আপুকে সাথে করে হাসি মুখে রক্ত দিতে গেলেন। একজন কখনো বায়োলজিকালি মা হতে না পারা মা, রক্ত দিলেন এক সদ্য জন্ম হতে যাওয়া নতুন মা কে। বাচ্চার জন্মের সাথে সাথে সেদিন দুই মায়েরও হয়তো জন্ম হলো৷
আমি জানিনা, বাচ্চাটা জন্মানোর পর তার বাবা ইমু আপুর কোলে বাচ্চাটাকে দিয়েছিলেন কি না। আমি জানিনা ৭ বছরের সেই বাচ্চা তাকে জন্ম দিতে সাহায্য করা তার সেই ‘হিজরা মায়ের’ কথা জানে কি না৷
আজ বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। পাশাপাশি ইমু আপুদের মতো মানুষেরাও যে রক্ত দিতে পারেন, সেই বিশ্বাসটা রাখুন। রক্তের ধর্ম হয়না, জাত হয়না৷
অজানা অচেনা মানুষদের রক্ত দিতে যেই রক্তদাতারা ছুটে আসেন তাদের শ্রদ্ধা জানাই। জানাই অভিনন্দন। মা বাবা জীবন দেন। আর রক্তদাতারা জীবন বাঁচান।
লেখা: দোলন চাঁপা দত্ত
ছবিতে: মাঝখানে লেখক, বামদিকে ইমু আপু, ডানদিকে নদী আপু।


